ধর্ম ও দর্শন ডেস্ক : বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্র মুসলমান জনগণ এক মহাসংকটকাল অতিক্রম করছে। যে সব দেশে মুসলমানগণ সংখ্যালঘু সেসব দেশের কোন কোনটিতে মুসলমান শুধু নিপীড়িত ও নির্যাতিত হচ্ছে শুধু তাই নয় বরং তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, দেশ হতে বিতাড়িত করা হচ্ছে। তথাকথিত অহিংসবাদীদের হিংসাত্মক ও হিংস্র আক্রমণে মানবতা যখন বিপর্যস্ত তখন বিশ্বমানবতাবাদীদের নিরব ভূমিকা শত প্রশ্নের জন্ম দেয় বৈ কি। শান্তিতে নোবেল বিজেতা যখন নিজ দেশের বর্বরতাকে চোখে দেখতে পান না তখন তার নোবেল জয় বিশ্বের সত্যিকারের শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোকে বেদনাহত না করে পারে না।
আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের মুসলমানরাও যে চরমভাবে বিপন্ন তার কোন দৃষ্টান্ত তুলে ধরার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। নির্যাতিত নিপীড়িত ও গণহত্যার শিকার হওয়ার জন্য শুধু জাতি হিসাবে বা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান পরিচিতিই যথেষ্ট। আর মুসলমান হিসাবে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখার প্রচেষ্টা, ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী নিজের জীবনকে পরিচালনা করা এবং ইসলামী অনুশাসনে উদ্বুদ্ধ করণের জন্য দাওয়াত ও সংগ্রামী ভূমিকায় যেসব মুসলমান অবতীর্ণ হয় বা হচ্ছে তারা বিশ্বের তাবৎ তথাকথিত প্রগতিশীলদের দৃষ্টিতে জঙ্গী, মৌলবাদী। সকল সভ্যতা ও সংস্কৃতি উন্নতি লাভ করুক তা বেহায়পনা হোক কিংবা বেলেল্লাপনা হোক তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি উন্নতি লাভ করলেই সমস্যা। সকল জাগরণ পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর, তাকে উৎসাহিত কর, এ জাগরণকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দাও, কিন্তু মুসলিম জাগরণের বিষয়টি অসহনীয়। তাকে রূদ্ধ কর, প্রতিরোধ কর। প্রয়োজনে নির্যাতনের স্টীমরোলার চালাও, গণহত্যা কর।
মুসলিম জাতি আজ অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত। তবে এই জাতীয় সংকট মুসলিম জাতির ইতিহাসে বারবার সৃষ্টি হয়েছে। হিজরী সপ্তম ও খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলিম জাতি এই জাতীয় অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত হয়েছিল। যখন তাতারীরা তুর্কিস্তান, ইরাক ও ইরানে ব্যাপক গণহত্যা ও লুটতরাজ চালিয়ে নগরের পর নগর দেশের পর দেশ ধ্বংসস্ত্তপে পরিণত করেছিল। মুসলিম বিশ্বের অস্তিত্বকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছিল। তাতারীদের হিংস্রতা ও বর্বরতা বিশ্বব্যাপী মানুষের অন্তরে এরূপ ভীতির সৃষ্টি করেছিল যে, ঐতিহাসিকগণ লেখেন, তাতারীদের আক্রমণস্থল ইরাক, ইরান ও তুর্কিস্তান হতে হাজার হাজার মাইল দূরের ইংল্যান্ডের সাগরপাড়ের জেলেরা তাতারীদের ভয়ে বহুদিন পর্যন্ত মাছ শিকার করতে বের হয়নি। কিন্তু তাতারীদের এই আক্রমণ ছিল নিছক সেনা আক্রমণ। তাদের আক্রমণ ছিল অস্ত্রকেন্দ্রিক। তাদের লক্ষ্য ছিল হত্যা ও দেশ দখল। কোন আদর্শ বিস্তার তাদের লক্ষ্য ছিল না। তাদের আক্রমণের পিছনে কোন আদর্শিক লক্ষ্য কিংবা কোন আদর্শিক আন্দোলন বা দর্শন নিয়ামক হিসাবে কাজ করেনি।
তবে বর্তমান পরিস্থিতি হতে উত্তরণ এবং সংকট ও শঙ্কা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মুসলিম জাতির জন্য আল্লাহ তাআলা কর্তৃক আরোপিত বহু শর্তাদি রয়েছে। কুরআন ও হাদীস, নববী জীবন চরিত্র ও সাহাবায়ে কেরামের কর্ম ও আদর্শের আলোকে কিছু শর্ত পূরণ করা আমাদের জন্য এই মুহূর্তেই জরুরী।আর তা হোল-
এই মুহূর্তে বিশ্বের সকল মুসলমান বিশেষত অপেক্ষাকৃত অধিক সংকটে নিপতিত মুসলমানদের জন্য সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা জরুরী ও কর্তব্য বিষয় হল, আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ, রুজু ইলাল্লাহ তথা একান্তভাবে আল্লাহ অভিমুখী হওয়া, তাওবা ও ইস্তিগফার করা, দুআ করা ও কাকুতি মিনতি সহকারে কান্নাকাটি করা।
কুরআন মজীদ বিষয়টাকে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে এবং বলছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
হে মুমিনগণ ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।-সূরা বাকারা, আয়াত ১৫৩
অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে-
أَمَّنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ وَيَجْعَلُكُمْ خُلَفَاءَ الْأَرْضِ
বরং তিনি যিনি আর্তের আহবানে সাড়া দেন যখন সে তাঁকে ডাকে এবং তিনিই বিপদ আপদ দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেন।-সূরা নামল, আয়াত ৬২
অন্যত্র বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ
মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর-বিশুদ্ধ তাওবা; তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কর্মগুলো মোচন করে দেবেন।-সূরা তাহরীম, আয়াত ৮
স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রীতি ছিল এই যে, যখনই তাঁর সামনে সামান্যতম উদ্বেগের কোন কিছুর আবির্ভাব ঘটত তখন তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং দুআয় মশগুল হতেন।
হযরত হুযাইফা রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত-
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا حزبه أمر صلى
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে যখন কোন উদ্বেগ সৃষ্টিকারী বিষয় উপস্থিত হত তখন তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন।-আবু দাউদ, হাদীস নং ১৩২১
হযরত আবুদ্দারদা রা. কর্তৃক বর্ণিত-
كان النبي صلى الله عليه وسلم إذا كانت ليلة ريح شديدة كان مفزعه إلى المسجد حتى تسكن الريح وإذا حدث في السماء حدث من خسوف شمس أو قمر كان مفزعه إلى المصلى حتى ينجلي.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অভ্যাস ছিল প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়ার রাত হলে তাঁর আশ্রয়স্থল হত মসজিদ যতক্ষণ না ঝড়ো হাওয়া শান্ত হত। আর যখন আকাশে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের ঘটনা ঘটত তখন তাঁর আশ্রয়স্থল হল নামাযস্থল (অর্থাৎ তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং নামায অব্যাহত রাখতেন) যতক্ষণ না সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণমুক্ত হয়ে যেত।
অতএব এ মুহূর্তে আমাদের সকলের জন্য জরুরী তাওবা ইস্তিগফার, আল্লাহ-অভিমুখিতা, দুআ ও মুনাজাত। সেই সঙ্গে কুরআন তিলাওয়াতের আমল অব্যাহত রাখা এবং আপদকালীন পঠিতব্য কুরআনের সূরা ও আয়াত বেশী বেশী পাঠ করা। যেমন সূরা ফীল, সূরা কুরাইশ, لا اله الا انت سبحانك انى كنت من الظلمين، نصر من الله وفتح قريب قريب ইত্যাদি।
এ ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামকেও এগিয়ে আসতে হবে। জনগণকে সচেতন করণ, পাড়া-মহল্লায় মক্তব প্রতিষ্ঠা করণসহ স্থান ও কাল উপযোগী যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উলামায়ে কেরাম যদি তাদের কর্মপরিধিকে বিস্তৃত করেন তাহলে তাঁরা নিজেরাও নিরাপদ হবেন,দেশও নিরাপদ হবে।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে,মাত্রাতিরিক্ত আবেগতাড়িত হয়ে খন্ডকালীন ও তৎক্ষণাৎ কর্মসূচীর অপেক্ষা সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত দীর্ঘস্থায়ী কর্মসূচী গ্রহণের মধ্যেই কল্যাণ নিহিত। আল্লাহ পাক আমাদের তাওফীক দান করুন এবং আমাদের কাজকে সহজ করুন। আমীন !
লেখক : মোস্তফা কবীর সিদ্দিকী
লেখক, গবেষক, প্রাবন্ধিক